দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের নিরাপত্তা প্রদানকারী এবং সবার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নয়াদিল্লির পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বিরূপ কৌশল এই ধারণার মূলে আঘাত হানছে। নেপাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ এবং পাকিস্তান, সবখানেই ভারতের কর্মকাণ্ড নিয়ে অসন্তোষ তীব্র হচ্ছে।
একসময় ভারত ও বাংলাদেশ নিজেদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে আখ্যায়িত করত। ভারত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল এবং আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলের উপর গভীর প্রভাব রাখত। তবে ২০২৪ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্কে ফাটল ধরে।
জনগণের অধিকারের দাবিতে পাশে না দাঁড়িয়ে নয়াদিল্লি দ্রুত ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেয় এবং অভ্যুত্থানে বহু মানুষ হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী জনমতকে আরও উস্কে দিয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অফ কেন্টাকির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নজরুল সাকিবের মতে, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে নির্লজ্জ স্বৈরতন্ত্রকে ভারতই সক্ষম করেছিল। বর্তমানে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন পলাতক আসামিকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ করেছে। অতীতে ভারত-বিরোধী বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা অনুপ চেটিয়াকে (উলফা নেতা) হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ যে সদিচ্ছা দেখিয়েছিল, ভারত এখন তা ফিরিয়ে দেবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।
ড. সাকিবের হুঁশিয়ারি, ভারত যদি চুক্তি অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে তা ভারত অনির্ভরযোগ্য মিত্র এমন বার্তাই দেবে, যা তার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই খারাপ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে পরিস্থিতি নজিরবিহীনভাবে খারাপ হয়েছে। তিনটি যুদ্ধ সত্ত্বেও টিকে থাকা ১৯৬০ সালের বিশ্বব্যাংক-মধ্যস্থতাধীন সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তিটি নয়াদিল্লি স্থগিত করেছে ২০২৫ সালে।
কাশ্মীরে একটি সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত সীমান্তের ওপারে একাধিক স্থানে হামলা চালায়, যা পরিস্থিতিকে চরম উত্তেজনায় নিয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে কূটনৈতিক চ্যানেল বন্ধ, বাণিজ্য স্থগিত এবং ক্রিকেট খেলার সৌজন্যতাও প্রায় বিলুপ্ত। ইসলামাবাদ এই পরিস্থিতিতে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো কারণ দেখছে না।
ভারতের প্রতিবেশীদের উপর আধিপত্যের উত্থান-পতন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় নেপালে। ঐতিহ্যগতভাবে ঘনিষ্ঠ হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর থেকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। ২০১৫ সালে নেপালের নতুন সংবিধান নিয়ে অসন্তুষ্ট মধেসি গোষ্ঠীর আন্দোলনের সময় ভারত নেপালের ওপর অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ' চাপিয়ে দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।
জ্বালানি, ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় নেপালি জনগণের মধ্যে ভারতের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি নতুন প্রশাসন কাঠমান্ডুতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কালাপানি ও লিপুলেখে সীমান্ত বিতর্ক নিয়ে চাপ বাড়িয়েছে। ভারতের ৮০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের বিরুদ্ধে নেপালে
মালদ্বীপের সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও ২০২৩ সালে নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু নির্বাচিত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাই ছিল মালদ্বীপকে ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বের করে আনা।
মুইজ্জু প্রকাশ্যে মালদ্বীপের মাটি থেকে স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় সামরিক কর্মীদের প্রত্যাহারের দাবি জানান এবং অবকাঠামো ও নিরাপত্তার জন্য চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। '#IndiaOut' প্রচারণা ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক অসন্তোষের প্রতিধ্বনি।
২০২২ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত প্রথম সহায়তাকারী হিসেবে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, জ্বালানি ও অত্যাবশ্যকীয় সরবরাহ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু শীঘ্রই বিতর্ক শুরু হয়।
সবচেয়ে বড় বিতর্কটি ছিল আদানি উইন্ড-পাওয়ার প্রকল্প নিয়ে। শ্রীলঙ্কার সমালোচকদের অভিযোগ, নয়াদিল্লি এই চুক্তির জন্য তীব্র লবিং করেছিল এবং এর ট্যারিফ স্থানীয় বিকল্পের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। বিরোধীরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর প্রধান গৌতম আদানির সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
যদিও শ্রীলঙ্কা নিজেকে 'পক্ষ না বেছে চলা' নীতিতে রাখতে চায়, তারা একদিকে আদানি প্রকল্প পুনর্বিবেচনা করছে, আবার অন্যদিকে ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রশমনের জন্য চীনা গবেষণা জাহাজের সফর সীমিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, "এর সীমিত সক্ষমতা, অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং কূটনৈতিক বার্তার অসঙ্গতি এটিকে দুর্বল করে তুলছে।
সূত্র: টিআরটি
No comments:
Post a Comment