রাজধানীর হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কড়াইল বস্তি যেন এক অচেনা ধ্বংসস্তূপ। মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাতভর দাউ দাউ করে জ্বলা আগুনের ছোবলে পুড়ে গেছে অন্তত দেড় হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ভোরের আলো ফুটতেই দেখা যায় নিভে যাওয়া আগুনের ধোঁয়া, গলে যাওয়া টিন, কাঠ, ছাই আর নিঃস্ব মানুষের হাহাকার। খোলা আকাশের নিচে এখন হাজারো মানুষ; তাদের মাথার উপর সুরক্ষা নেই, পায়ের নিচে ভরসার জমি নেই।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই বস্তিজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই বাতাসে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণাংশে, তারপর ধীরে ধীরে পুরো এলাকায়। ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট রাতভর কাজ করেও আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা।
বুধবার সকালে দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাজারো পরিবার। পোড়া ঘরগুলোর জায়গায় এখন শুধু ছাই, বাঁকানো লোহার কাঠামো আর গলে যাওয়া প্লাস্টিকের স্তূপ। খাদ্য, পোশাক, গৃহস্থালি সামগ্রী, সঞ্চিত অর্থ এক মুহূর্তে সবই ভস্মীভূত।
সর্বস্ব হারানো এক ব্যক্তি হতাশ কণ্ঠে বলেন, আমরা তো গরিব মানুষ, সবকিছুই ছিল এই ঘরে। বাঁচাতে পারিনি কিছুই। এখন কোথায় যাব, কী করে থাকব কিছুই বুঝতে পারছি না।
অগ্নিকাণ্ডের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য ছিল নিখোঁজদের খোঁজে ছোটাছুটি। অনেকে জানে না তাদের আত্মীয়-স্বজন কোথায়। মিনারা বেগম ভাঙা গলার কান্নায় বলছিলেন,
এই জায়গাতেই ছিল আমার মা। সবাই পালাতে পেরেছে, কিন্তু আমার মা আসছে না। একটু দেখেন, আমার মাকে খুঁজে দেন।
যদিও এখনও পর্যন্ত কোনো হতাহতের আনুষ্ঠানিক তথ্য নেই, তবুও নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজে উদ্বেগ ও আতঙ্ক কাটছে না পরিবারগুলোর।
বস্তির মানুষের বড় একটি অংশ আগুন লাগার পর হাতের কাছে যা পেয়েছেন তা নিয়েই বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। অনেকেই ঘর থেকে কিছুই নিতে পারেননি।
এক নারী জানান, আমরা বউ-ঝি, নাতি সকলেই এক কাপড়ে বের হয়েছি। কিছুই বাঁচাতে পারিনি।
এখন তাদের থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই, শিশুদের জন্য দুধ-ওষুধ নেই। বর্ষার সম্ভাবনা কিংবা শীতের কামড় সবই এখন তাদের জন্য আরও বড় ভয়।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরপরই গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি। কমিটিটি আগুনের সূত্র, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও অব্যবস্থাপনার দিকগুলো যাচাই করবে।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, উদ্ধার কাজ পুরোপুরি শেষ হলে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষতির বিস্তারিত হিসাব জানা যাবে। আপাতত বলা যায়, ক্ষতি ব্যাপক।
গুলশান ও বনানীর মাঝখানে প্রায় ৯০ একর জায়গাজুড়ে কড়াইল বস্তি শহরের অন্যতম বৃহৎ বস্তি। এখানে প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। দিনমজুর, রিকশাচালক, পোশাককর্মী, ছোট দোকানি বেশিরভাগই সীমিত আয়ের মানুষ, যাদের দিন চলে দৈনিক আয়ের উপর নির্ভর করে।
বস্তির ঘরগুলো টিন, বাঁশ আর কাঠে নির্মিত যা অগ্নিকাণ্ডের জন্য সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ। একবার আগুন লাগলে মুহূর্তেই বিস্তার ঘটে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ঘরবাড়ি হারিয়ে এখন তাদের চোখে জীবনের নতুন হিসাব—কোথায় থাকবেন, কীভাবে খাবেন, কীভাবে আবার ঘর তুলবেন। শিশুবৃন্দ থেকে প্রবীণ পর্যন্ত সকলের মুখেই আতঙ্ক আর অস্থিরতা।
এক ভুক্তভোগী যুবক বলেন, যে জায়গায় ঘর ছিল এখন সেখানে শুধু ছাই। কীভাবে আবার শুরু করব জানি না।
সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা কবে পাওয়া যাবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। অনেকে স্থানীয় স্কুল, খোলা মাঠ, রাস্তাঘাটে অস্থায়ী আশ্রয় নিয়েছেন।
ঢাকা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণসহায়তার প্রাথমিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অস্থায়ী থাকার জায়গা, খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, মানুষ যাতে রাত কাটানোর জায়গা পায়, খাবার পায় আমরা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।
যদিও ক্ষতির পরিমাণ বিশাল, তবুও বস্তিবাসীদের একটাই লক্ষ্য আবার নতুন করে ঘর তোলা, জীবনে নতুন পথ খুঁজে নেওয়া। পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ কেউ এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন কোনো কাজে লাগতে পারে এমন সামান্য কিছু।
তাদের চোখে জল, মনে দুঃখ তবুও ভরসা একটাই, তারা একদিন আবার ঘুরে দাঁড়াবেন।
No comments:
Post a Comment